মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০২৩

এরদোগানের জয়ের রহস্য আর বিরোধী দলের পরাজয়

এরদোগান কে পশ্চিমা বিশ্বের কেউ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে চায়নি, কারণ এরদোগান ইসলামপন্থী এবং তাদের পুরোপুরি অনুগত নয়। 
তারা বিরোধী দল সিএইচপি কে ক্ষমতায় দেখতে চায় যারা পুরোপুরি সেক্যুলার এবং ওয়েস্টার্ন দের সম্পূর্ণ অনুগত। সিএইচপি এর সবচেয়ে বড়ো কুখ্যাতি হল তারা ইসলামবিরোধী কামাল আতাতুর্কের দল। আর কামাল আতাতুর্কের শাসনামল সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন এরদোগান কে হারানোর জন্য। 
মিলিটারি স্টেপ নেওয়া ছাড়া এমন কোনো স্টেপ নেওয়া বাদ রাখেন নি যাতে করে এরদোগান বেকায়দায় পড়ে যায়, এরদোগানের জনপ্রিয়তা কমে যায়, এরদোগান যেনো নির্বাচনে হেরে যায়। এখন এরদোগান তো আর আমাদের দেশের আওয়ামী লীগ আর বিএনপির এর মতো দুর্নীতিবাজ না যে জনগণ তাকে ভোট না দিয়ে হারিয়ে দেবে। 



তাই এরদোগানের জনসমর্থন কমিয়ে দেয়ার জন্য তুরস্কের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। তাতে করে তুরস্কের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তুর্কি মুদ্রা লিরার দাম কমে যায়, দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র আর মধ্যবিত্তরা অনেক ভোগান্তিতে পড়ে যায়। 
এর ফলে বিগত ৫ টি নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়া আতাতুর্কের সিএইচপি এবার সাহস সঞ্চার করে এরদোগান কে হারানোর জন্য সকল সেক্যুলার দল মিলে জোট করা হয়, যেনো মুদ্রাস্ফীতি আর দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি এবং ভুমিকম্প ইসু কে কাজে লাগিয়ে এরদোগান কে হারানোর জন্য। 
কিন্তু সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দিয়ে অবশেষে বিগত ৫ টি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় এবারো বিজয়ী হলেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তো এরদোগান কিভাবে এতো কঠিন চাপ থেকে উতরে গেলেন এবং বিরোধী দল কেন এত সহজ সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারলে না সেটাই ব্যাক্ষা করছি।

১. ধর্মীয় স্বাধীনতা: 

এটা সবাই জানে যে কামাল আতাতুর্কের দল ক্ষমতায় থাকতে ইসলাম কে এক প্রকার নিষিদ্ধই করে দিয়েছিল। এরদোগান আসার আগ পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ ৯০ বছর এভাবেই চলছিলো। যদিও এরদোগান ক্ষমতায় আসার আগেও দুই জন এই পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিল। আদনান মেন্দিরেস আরবীতে জন প্রচলন করার কারণে তাকে সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করে ফাঁসি দেয়। এরপর নিজামুদ্দিন এরবাকানো চেষ্টা করেছিলেন ইসলামী বিধি বিধান পুনরায় চালু করার জন্য। কিন্তু তাকেও সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করে। এরদোগান ক্ষমতায় এসে শুরুতে সেক্যুলার দের সাথে তাল মিলিয়ে চলে শক্তি সঞ্চয় করে পরে একের পর এক ইসলামী বিধানের উপর বিধিনিষেধ তুলে নেয়। এরদোগানের পূর্বের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা তুরস্কের ইসলামপ্রিয় জনগণ ভুলে যায়নি। আর এই নির্বাচনে এটাই মূলত অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে।

২. মুসলমানদের ঐক্য এবং সেক্যুলারদের বিভক্তি:

বলা হয়ে থাকে তুরস্কের জনগণের ৫০% ইসলামপন্থি অরে বাকি ৫০% সেক্যুলার। তুরস্কের এই ৫০% ইসলামপন্থীদের প্রায় ৯৫% এরদোগান কে ভোট দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ তুরস্কের মুসলিমদের মধ্যে বিভক্তি কম বরং ঐক্যই বেশি। অন্য দিকে তুরস্কে সেক্যুলারদের মধ্যে বিভিন্ন দলের বিভক্তি আছে। এবং একেক দলের ভোট ব্যাংক আলাদা। যে কারণে কোন সেক্যুলার দল এককভাবে কখনো সকল সেক্যুলার দের ভোট পায় না। অর্থাৎ সেক্যুলা দের ভোট ভিন্ন ভিন্ন সেক্যুলার দলে বিভক্ত।

৩. তুর্কি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা: 

এরদোয়ান তুর্কি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে তুর্কি দের মধ্যে ইউরোপিয়ানদের থেকে আলাদা থাকার একটা ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছিলেন। এর আগে তুর্কি দের কোনো কনফিডেন্স ছিলো না। এর আগে অধিকাংশ তুর্কি ভাবত যে তাদের নিজেদের আলাদা জাতি সত্তা বোধ বলে কিছু নেই। ইউরোপিয়ানরা যা বলবে সেটাই সেটাই তাদের জন্য আদর্শ। কিন্তু এরদোগান তুর্কি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করে ইউরোপিয়ান গোলামী করার মানুষিকতা বাদ দিয়ে একটি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে তুর্কিদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যেখানে বিরোধী দল ইউরোপিয়ান দের গোলামী করার নীতিতে বিশ্বাসী যেটা তুরস্কের অধিকাংশ মানুষ পছন্দ করে না।

৪. সামরিক শিল্পের উন্নয়ন এবং তরুন ভোটার দের আকৃষ্ট করা: 

এরদোগান তুরুস্কের সামরিক শিল্প কে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অত্যাধুনিক অস্ত্র ড্রোনে জঙ্গিবিমান জলযান আবিষ্কারের মাধ্যমে তিনি তুরস্ক কে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর নির্বাচন কে সামনে রেখেও তিনি আগামীর জন্য আরো উন্নত সমরাস্ত্র প্রদর্শন করেছেন। যা দেখে তুরস্কের তরুণ ভোটাররা আকৃষ্ট হয়েছেন। অন্যদিকে বিরোধী দল বলেছেন যে তুরস্কের সকল সমরাস্ত্র এগুলো সব নকল, প্লাস্টিকের আর তুরস্কের শক্তিশালী সমরাস্ত্রের কোনো প্রয়োজন নেই। যেটা তুরস্কের তরুণ জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। কেননা তুরস্কের তরুণ ভোটাররা তুরস্ক কে একটি শক্তিশালী দেশ হিসেবে দেখতে চান। বিরোধী দলের সামরিক দিক দিয়ে অনিহার কারনে তুরস্ককে শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে চাওয়া তুরস্কের তরুণ জনগণের মন জয় করতে পারেনি বিরোধী দল।

৫. বিনামূল্যে গ্যাস দেওয়া: 

তুরস্কের নিজ ভূখণ্ডে পাওয়া প্রাকৃতিক গ্যাস এরদোগান বিনামূল্যে সে দেশের মানুষকে দেন। যেটা তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে ফ্রি গ্যাস দেওয়া নিয়েও বিরোধী দল আপত্তিকর বক্তব্য দেয়। বিরোধী দল দাবি করে যে দেশে কোন গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া যায়নি। এগুলো রাশিয়ান গ্যাস। রাশিয়া এরদোগান কে ক্ষমতায় রাখার জন্য এই গ্যাস দিয়েছেল। আর এটাও সে দেশের মানুষ ভালোভাবে নেয়নি।

৬. দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বৃদ্ধি: 

তুরস্কে দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে এটা সত্য কিন্তু এরদোগান তো বসে থাকার মানুষ নয়। এরদোগান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন সময় সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন বাড়িয়েছে। আর তুরস্কের আইন হলো সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন বাড়লে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন একই হারে বাড়াতে হবে। আর নির্বাচনের ঠিক ৫ দিন আগে তিনি সরকারি চাকুরিজীবীদের প্রায় ৪৫% বেতন বাড়িয়ে দেন। ফলে বেসরকারি চাকরিতেও বেতন বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিনিয়ত বেতন বাড়ানোর জন্য তুরস্কের মানুষের দুর্ভোগ অনেকটাই কমেছে। অন্যদিকে বিরোধী দল অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোনো পথ দেখাতে পারেনি। যা দিয়েছে সেগুলোও অবাস্তব, যা তুরস্কের মানুষ বিশ্বাস করেনি। যেমন কেমাল বলেছে ক্ষমতায় এলে মাত্র ছয় মাসের মধ্যে তুরস্কের মানুষদেরকে ইউরোপীয়ান দেশে বিনামূল্যে ভ্রমনের ব্যবস্থা করবে। যেটা অকল্পনীয়। 

৭. বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের দমন:

এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দিদের দমন করে আসছেন, যেখানে বিরোধী দল কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথেই বেশি খাতির লাগিয়েছেন যেটা তুরস্কের জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। এমনকি কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের পাশে থাকার প্রতিশ্রতি দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয় যা গোটা তুরস্কে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় এবং বিরোধী দল কে ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়।

৮. পশ্চিমা মিডিয়ার এরদোগান বিরোধী প্রচারণা: 

তুরস্কের অধিকাংশ মানুষ আমেরিকা সহ পশ্চিমাদের পছন্দ করে না। আর পশ্চিমা মিডিয়া শুরু থেকে এরদোগানের বিরুদ্ধে তথ্য সন্ত্রাস চালালে তুরস্কের জনগণ বুঝতে পারে যে পশ্চিমারা তুরস্কের ভালো চায় না তারই যদি এরদোগানের বিরোধিতা করে তাহলে এর্দোগানই তুরস্কের প্রকৃত শাসক।

৯. ভূমিকম্প পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলাঃ 

এবারের ভুমিকম্পকে সেক্যুলারগন আশির্বাদ হিসেবে মনে করেছিল। তারা ভেবেছিল যে এরদোয়ান ভুমিকম্প পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে পারবে না। আর তাই এরদোয়ান কে চাপে ফেলে সহজেই হারিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এরদোয়ান খুব দ্রুততম সময়ে অসংখ্য বাড়ি নির্মান শেষ করে ভুমিকম্পে বাড়ি হারানো মানুষের হাতের নতুন বাড়ির চাবি বুঝিয়ে দেন। যার ফলাফল একদম নগদে। অর্থাৎ ভুমিকম্প কবলিত এলাকার প্রায় সব জায়গায় এরদোয়ান জিতেছে। যা পশ্চিমা এবং সেক্যুলারদের বিস্মিত করেছে।

সার্বিকভাবে এরদোগান অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জয় ছিনিয়ে আনলেন। জো বাইডেন অনেক চেষ্টায় করেছিলেন। কিন্তু সফল হলেন না। আর এরদোগানের এই জয় মুসলিম উম্মার এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছেন।
আগামীতে আমেরিকার একমুখি বিশ্ব ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে হুমকিতে পড়লো। চীন রাশিয়ার সাথে মুসলিম বিশ্বের পাওয়ারফুল দেশ হিসেবে তুরস্কের যোগদান করে সেটা আরো ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে। তখন আমেরিকার সাথে চীন রাশিয়ার দ্বন্দ্ব আরো বাড়বে। অন্যদিকে মধ্য প্রাচ্যের আরব দেশগুলো ও এরদোগানের সাথে চলতে আগ্রহী। আশা করি এরদোগান আরব দেশগুলো সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করবেন। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

You can read more

কোরআন ও হাদিস স্বীকৃত আয়াতে শেফা বা সুস্থ হবার তদবির

সুস্থতা-অসুস্থতা উভয়টিই আল্লাহর নেয়ামত। সুস্থ হলে মানুষ বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে। শোকর আদায় করে কৃতজ্ঞ হতে পারে। আর অসুস্থ হলে আল্লা...